নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তিনি মরেও বেঁচে রইলেন। একজনের নয়, তার প্রাণ নতুন ভাবে প্রতিস্থাপিত হলো পাঁচজনের শরীরে। তিনি মরেও যেন অমর হয়ে রইলেন। শুধু তাই নয় গোটা সমাজের কাছে তিনি এক দৃষ্টান্ত। চিকিৎসা করাতে গিয়ে মর্মান্তিক পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং-এর প্রত্যন্ত গ্রামের এক মহিলার। মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে প্রথমে মেদিনীপুর এবং পরে কলকাতার এস এস কে এম এ ভর্তি হন তিনি। বেশ কয়েকদিনের অসম চেষ্টার লড়াই অবশেষে থেমে যায়। পারিবারিক সিদ্ধান্তক্রমে তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপিত করা হয় পাঁচ-পাঁচ জনের শরীরে। ফের মরণোত্তর অঙ্গদানের নজির। প্রত্যন্ত এক গ্রামের এক পরিবারের ভাবনা, তাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সকলে। পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়া এক মহিলার চোখ থেকে লিভার প্রতিস্থাপিত করা হলো অন্যের শরীরে। পিজি হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে ভর্তি থাকাকালীন পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং ব্লকের সিঁদুরমুড়ি গ্রামের বাসিন্দা সুজাতা মণ্ডলের (৪৭) ব্রেন ডেথ বা মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয় গত রবিবার (১৯.০১.২০২৫)। তাঁর পরিবারের সম্মতিতে অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত হয়। তার প্রেক্ষিতে নতুন জীবন পেতে চলেছেন কমপক্ষে পাঁচজন। ওই রাতেই অঙ্গ উত্তোলন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। দু’টি কর্নিয়া বাদে গ্রহীতাদের শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া শেষ হয় সোমবার সকালের মধ্যেই। পিজি সূত্রে খবর, সুজাতাদেবীর লিভার পেয়েছেন পিজি হাসপাতালে ভর্তি ২৯ বছর বয়সি এক যুবক। লিভারের জটিল রোগে ভুগছেন তিনি। অঙ্গ প্রতিস্থাপন ছাড়া তাঁর কাছে বিকল্প কোনও উপায় ছিল না। দাতার দু’টি কিডনি কাজে লাগানো হয়েছে। একটি কিডনি পেয়েছেন পিজির নেফ্রোলজি ওয়ার্ডে ভর্তি এক মহিলা। অন্যটি পেয়েছেন মুকুন্দপুর লাগোয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ৪৯ বছর বয়সি এক ব্যক্তি। দু’জনেই অন্তিম পর্যায়ের কিডনি অসুখে (ক্রনিক কিডনি ডিজিজে) আক্রান্ত ছিলেন। সুজাতাদেবীর দু’টি চোখের কর্নিয়া দান করা হয়েছে পিজি হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়ে, গত রবিবার (১২.০১.২০২৫) জানুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের সিঁদুরমুড়ি গ্রামের বাসিন্দা সুজাতাদেবী স্বামী স্বপন মন্ডলকে নিয়ে ডেবরায় চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। বাইক নিয়ে ফেরার পথে বাড়ির সামনেই পথ দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। দুর্ঘটনার জেরে রাস্তায় পড়ে যান। মাথায় গুরুতর আঘাত পান। তাঁকে ভর্তি করা হয় এখানকার ট্রমা সেন্টারে। প্রাণ বাঁচাতে অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। রবিবার, ১৯ জানুয়ারি তার মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা করে পিজি’র ব্রেন ডেথ কমিটি। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন সুজাতা মন্ডল এর মরণোত্তর অঙ্গদানের। তারপরেই মৃত সুজাতা দেবীর শরীরের সমস্ত অঙ্গদান করা হয়। এ ব্যাপারে সুজাতা মন্ডলের স্বামী স্বপন কুমার মন্ডল সহ পরিবারের সদস্যরা জানান, যিনি চলে গেছেন তাকে তো আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার অঙ্গ যদি অন্য কোন অসুস্থ মানুষের শরীরে স্থাপন করা হয় এবং সেই মানুষ যদি নতুন জীবন পান সেখানেই মায়ের জীবন বেঁচে থাকবে। অন্যদিকে সবং এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবী শিক্ষক ষড়ানন পণ্ডা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অখন্ড মেদিনীপুর জেলায় তার বাবাই ছিলেন প্রথম অঙ্গদাতা। মৃত্যু সবসময় দুঃখজনক। আমি শুনে খুব গর্বিত। এই পাড়াগাঁয়ের কোন পরিবার থেকে মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে। মায়েদের দেহটি যদি চিকিৎসা বিভাগে যায়। তা মানুষের জন্য খুব উপকার। কিন্তু উনার তো মৃত্যু হল, ওনাকে তো আটকানো যাবে না। মৃতের অঙ্গ পতঙ্গ গুলি অন্যের মধ্যে স্থাপন করে তিনি অমর হয়ে গেলেন। সাধারণ মানুষকে আহবান করব এভাবেই অঙ্গদানের মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করুন। প্রত্যন্ত গ্রাম। যে গ্রামে এখনো শিক্ষার আলো ঠিকমতো পৌঁছায়নি সেই গ্রামেই এক গৃহবধুর মৃত্যু প্রমাণ করল সামাজিক সচেতনতা। মরেও যেন তিনি বেঁচে রইলেন সকলের কাছে, নতুন জীবন দিলেন পাঁচজনকে।